বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গাজায় আপাতত স্বস্তি 

  • সম্পাদকীয়   
  • ২৬ অক্টোবর, ২০২৫ ২২:৪১

গাজায় গণহত্যা বন্ধের লক্ষ্যে মিসরের শার্ম আল শেখে মার্কিন শান্তি প্রস্তাবে বিবদমান পক্ষগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে গত ১০ অক্টোবর ২০২৫ থেকে কার্যকর হয়েছে যুদ্ধ বিরতি। কয়েক ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য ওই শান্তিচুক্তির আলোকে হামলা বন্ধ করে ১০ অক্টোবরের মধ্যে গাজার একটি নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে ইয়েলো লাইন নামক কৌশলগত সীমারেখার মধ্যে স্থবির হয়ে পরেছে দখলদার সেনাদের কর্মকান্ড। যা মূলত গাজা থেকে স্থায়ী ও সম্পুর্ণ ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের পূর্বাবস্থা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। শান্তিচুক্তির প্রথম ধাপের শর্তের আলোকে আক্রান্ত না হলে ইসরায়েলি সেনারা আপাতত গাজায় যত্রতত্র ও নির্বিচার গুলি চালাতে পারবে না। পক্ষান্তরে দ্রুত দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়ে গাজার বিভিন্ন অংশে অবস্থান নিয়েছে হামাসের নিরাপত্তা বাহিনী। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের শুরুতেই নতুন করে সাত হাজার যোদ্ধাকে রণাঙ্গনে নিয়ে এসে গাজার সামগ্রিক নিরাপত্তা তদারকিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে হামাস। সেই সঙ্গে গাজার জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফেরাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টাগুলোকে ফলপ্রসূ করতে অব্যাহত রয়েছে হামাসের তৎপরতা। বিশেষত ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে দ্রুত খাদ্য পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোড় প্রচেষ্টায় কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে হামাসের বিভিন্ন বাহিনী। শান্তিচুক্তির শর্ত মোতাবেক ইতোমধ্যেই মুক্ত হয়েছে সব জীবিত ইসরায়েলি জিম্মি। মৃত জিম্মিদের কয়েকজনের মৃতদেহ ইসরায়েলে পাঠানো হয়েছে। যদিও এখনো কয়েকটি মৃতদেহ ফেরত দিতে পারেনী হামাস। এজন্য তারা কিছু সময় চেয়েছেন। বিপরীতে ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছে প্রায় তিন হাজার ফিলিস্তিনি। যার মধ্যে রয়েছে হামাসের গুরুত্বপূর্ণ চার সদস্য। ধারণা করা হচ্ছে বিভিন্ন মেয়াদে ইসরায়েলে কারাভোগ করা এই চার নেতা হামাসের নেতৃত্ব শুন্যতা দূর করতে সক্ষম হবে। গাজা যুদ্ধে বিবদমান দুই পক্ষ হামাস ও ইসরায়েলের মৌখিক সম্মতিতে যেসব দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে তারা সবাই মধ্যস্থতাকারী। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছারাও রয়েছে তুরস্ক, মিসর ও কাতার। এই দেশগুলো মূলত চুক্তির গ্যারেন্টর হিসেবে কাজ করবে। এই অবস্থায় ১০ অক্টোবরের পর গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধ থাকলেও হামাসের অভিযোগ কমপক্ষে পঞ্চাশ বার যুদ্ধ বিরতির শর্ত লংঘন করেছে আইডিএফ। বিপরীতে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর থাকার মধ্যেই ভিন্ন ধরনের একটি আক্রমণে গাজায় প্রাণ হারিয়েছে দুইজন ইসরায়েলী সেনা। ওই ঘটনায় আহত হয়েছে আরও কয়েক জন। সঙ্গতকারনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গাজায় বিদ্যমান শান্তি কতদিন টিকে থাকবে? এই অনিশ্চয়তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসরায়েলি দুর্বৃত্তায়নের সুদীর্ঘ ইতিহাস। পেছনের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে কখনোই এ ধরনের চুক্তি কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সিদ্ধান্তকে পরোয়া করেনি ইসরায়েল। তাই মার্কিন প্রস্থাবিত তুরস্ক, কাতার, সৌদি আরব, মিসরের মধ্যস্থতায় কয়েক ধাপের গাজা শান্তিচুক্তির প্রতি ইসরায়েল কতটা সম্মান প্রদর্শন করবে সেটি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উৎকন্ঠা খুবই স্বাভাবিক। সর্বশেষ মার্কিন শান্তি প্রস্থাব বাস্তবায়নের এই প্রক্রিয়ায় -ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হামাসের পরোক্ষ আলোচনার খবর সম্পর্কে সবাই অবগত আছেন। হামাসকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে তাদের সঙ্গে যেকোনো ধরনের আলোচনায় অংশ নিতে বরাবর অনীহা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের। এমনকি ৭ অক্টোবরের পরেও হামাসের আলোচনায় প্রস্থাব প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েল। এ পর্যায়ে যুদ্ধের মাধ্যমে জিম্মি উদ্ধারের ইসরায়েলি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই বাস্তবতায় মিসরে হামাস- ইসরায়েল, হামাস- যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষ আলোচনা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির বড়ো ধরনের রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবেই দেখা হচ্ছে। হামাসের রাজনৈতিক শাখার গুরুত্বপূর্ণ নেতা খলিল আল হায়ার নেতৃত্বে ওই আলোচনায় অগ্রাধিকার পেয়েছিল জিম্মি মুক্তি ও মানবিক সহায়তার বিষয়গুলো। গণমাধ্যমে চাউর হলেও হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, গাজার সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রশাসন প্রতিষ্টার মার্কিন ধারনা নিয়ে যেকোনো আলোচনার খবর প্রত্যাখ্যান করেছে প্রতিরোধ সংগঠনটি। এ পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও কয়েকটি আরব দেশ এই চুক্তিকে স্বাগত জানালেও সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে রাশিয়া, ইরান ও চীন। ইতোমধ্যে যুদ্ধ বিরতি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশে ইসরায়েলে মোতায়েন করা হয়েছে মার্কিন সেনা। সেইসঙ্গে গাজায় আরও কিছু দেশের সৈন্য পাঠানো হতে পারে বলে কানাঘুষা চলছে। ফলে ওই শান্তিচুক্তির আলোকে গাজার ভবিশ্যত নিয়ে চলছে বহুমাত্রিক আলোচনা। এক্ষেত্রে হামাসকে বাদ দিয়ে গাজায় একটি অন্তর্বতী প্রশাসন গড়ে তোলার ব্যপারে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, তুরস্ক, সৌদি আরব, আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য গণমাধ্যমে এসেছে সেগুলো বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। যদিও কিছুদিন থেকে ট্রাম্প ব্লেয়ারের নেতৃত্বে একটি বিকল্প অন্তর্বতী প্রশাসনের কথা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এখনো এ ধরনের কোনো প্রাশাসনিক কাঠামো গাজায় দৃশ্যমান হয়নি। অন্যদিকে অঞ্চলটির প্রশাসনিক কাঠামো ইতোমধ্যেই ৭ অক্টোবর ২০২৩ এর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সঙ্গত কারনেই এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে শান্তিচুক্তিতে লাভ ক্ষতির খতিয়ান কি? চুক্তিতে হামাস নাকি ইসরায়েল কে এগিয়ে রইলো? সেইসঙ্গে চুক্তির পরবর্তী ধাপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে গাজায় প্রকৃত শান্তি ফেরানোর সম্ভাবনা কতোটুকু?

মিসরের শার্ম আল শেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কতিপয় আরব দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সম্পাদিত গাজা শান্তিচুক্তিকে অপেক্ষাকৃত দূর্বল একটি পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের সুস্পষ্ট রূপরেখা না থাকায় এই শান্তিচুক্তি একটি অসাড় প্রবণতা ব্যতিত আর কিছুই নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন সময় ইসরায়েলি স্বার্থ সুরক্ষার পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিরই আরেকটি মঞ্চায়ন হচ্ছে সর্বশেষ গাজা শান্তিচুক্তি। যেখানে সংকটের মূল উপাদান উপেক্ষা করে ফিলিস্তিনি জনগণকে আরেকবার বোকা বানানোর চেষ্টা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রকৃত শান্তি সেইসঙ্গে দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের ঐতিহাসিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে পশ্চিমা দেশগুলোর সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই এই প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভুতিশীল পক্ষগুলোকে সঙ্গে নিয়েই চুক্তিতে উপনীত হলে সেটি সব পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হতো। ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য পক্ষগুলোর অনুপস্থিতির বিপরীতে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিটি দেশই ইসরায়েলের ভূমি দস্যুতা,দখলদারিত্বকে বৈধতা দিতে বরাবর তৎপর ছিল বা এখনো আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় দেশগুলোর একপেশে পক্ষপাতদুষ্ট ফিলিস্তিন নীতির কথা সবারই জানা। দ্বিরাষ্ট্র ভিত্তিক ভূমি বন্টনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সমাধান প্রক্রিয়া অবজ্ঞা করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোই ফিলিস্তিনিদের দূর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে। ফিলিস্তিনের রাষ্ট স্বপ্নকে দু:স্বপ্নে পরিণত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়রাই। এই দেশগুলোর সঙ্গে কয়েকটি আরব দেশও একইভাবে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ বৃদ্ধির জন্য বহুলভাবে দায়ী। যে কারণে এসব দেশের সিদ্ধান্তের আলোকে গৃহীত শান্তিচুক্তিকে মন্দের ভালো হিসেবে গ্রহণ করে হামাস কার্যত ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নির্মম ইসরায়েলি বর্বরতা থেকে সাময়িক মুক্তি খোঁজেছে। সাধারণ বিচারে এটা স্থায়ী, ন্যায্য সমাধানের কোনো গ্রহণযোগ্য চুক্তি নয়। তাহলে কি হতে পারে? পৃথিবীর পরিবর্তন হয়েছে। তাই নতুন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সুবিধা নিয়ে উজ্জিবিত হয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম। ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের আল আকসা তুফান অভিযান ছিল পরিবর্তিত বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমিকরণের ফলাফল। যে ঘটনায় কেঁপে উঠেছে ইসরায়েলের রাষ্টিয় অস্তিত্ব। বলা চলে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সামরিক সমিকরণের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সবটুকু সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিজয়ের কাছাকাছি পৌছে গেছে প্রতিরোধ যুদ্ধ। আর ফিলিস্তিনিদের এই ন্যায়সঙ্গত লড়াইয়ে এবার শক্তি যুগাচ্ছে পুরো বিশ্বই। ব্যতিক্রম শুধু যুক্তরাষ্ট্র সেইসঙ্গে কয়েকটি ইউরোপিয় ও আরব সরকার। অন্যদিকে সমগ্র বিশ্বের প্রায় সব মানুষের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিরা ঘনিষ্টভাবে পাশে পেয়েছে ইরান, রাশিয়া, চীনসহ অনেক দেশকে। সমিকরণের এই বাস্তবতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত হচ্ছে গাজার পরিস্থিতি ঘিরে ইসরায়েলবিরোধী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর কৌশলি অবস্থান। যেখানে হামাসসহ সকল ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীরা একটি কৌশল অবলম্বন করে সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছে। সেইসঙ্গে ইসরায়েলের যেকোন দূরভিসন্ধিমূলক তৎপরতার জবাবে নিজেদের যুদ্ধ প্তস্তুতির প্রতিও সজাগ রয়েছে হামাস। এই অবস্থায় গত কয়েক দিনের গাজা পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত থাকলেও যেকোন মুহুর্তেই যুদ্ধ বিরতি ভেঙে পরার শঙ্কা রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক অঙ্গণ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ইসরায়েলের পক্ষে পূর্বের মতো বেপরোয়া আচরণ করা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে এই শান্তিচুক্তি ভেঙ্গে গেলে বড়ো ধরনের প্রশ্নের মুখে পরবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তি মূলক ভূমিকা। তাই এই স্থিতাবস্থা যা হামাসসহ অন্যান্য ফিলিস্তিনি শক্তিগুলোকে বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। সব মিলিয়ে গাজা শান্তিচুক্তির পরিণতি সম্পর্কে অনিশ্চয়তা থাকলেও আপাতত স্বস্তিতে রয়েছে গাজার জনগণ।

লেখক: হাসান জাবির: বিশ্লেষক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা।

এ বিভাগের আরো খবর